সম্পদের হিসাব না দিতে জেনারেল জিয়ার দোহাই আমলাদের

আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান,
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ৭ মার্চ ২০২২

বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চেয়ে গত ১৪ বছরে বহুবার চিঠি দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীও এ নিয়ে অনেকবার কথা বলেছেন। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই তাতে পাত্তা দেননি। এ সুযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও পার পেয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নতুন নির্দেশনা দিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্পদের হিসাব না দিতে এবার সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দোহাই দেওয়া হয়েছে।

আমলাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের আইন। জিয়াউর রহমান আইনটি প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি অবৈধ স্বৈরশাসক ছিলেন, তার আইন এখনও বহাল রাখা উচিত নয়।

আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাঁচ বছর পরপর তার সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। তবে এ বিধিমালার কোনো বাস্তবায়ন নেই। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সম্পদের হিসাব না দিলে শাস্তির কোনো বিধান নেই। ফলে প্রতিবছর চিঠি দেওয়া হলেও সম্পদের হিসাব দিচ্ছেন না আমলারা।

গত বছরের ২৪ জুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী নিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর তাদের কর্মীদের সম্পদের হিসাব দিতে নির্দেশ দেয়; কিন্তু বছর শেষ হলেও নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি।

বিধিমালাটি করা হয়েছিল ৪২ বছর আগে। এরপর ২০০২ ও ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় নির্দেশনাগুলো সংশোধন করা হয়নি। তাই ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ফের সংশোধন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু আট বছরেও তা শেষ করতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত বছর আচরণ বিধিমালা সংশোধন বিষয়ে কয়েকটি কর্মশালা আয়োজন করা হয়। কিন্তু কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে পরিস্কার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়। ওই হিসাব বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। সেগুলো পর্যালোচনা করে বলা হয়নি, কার সম্পদ বেড়েছে বা কমেছে। এরপর ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে শুধু ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হলেও তা পর্যালোচনা করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপর একাধিকবার সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও হিসাব দেননি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সম্পদের হিসাব দেওয়ার অনীহা কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়।

জনস্বার্থে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, কর্মকর্তারা জনগণের টাকায় বেতন পাচ্ছেন, জনগণের জন্যই কাজ করছেন।

এদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাপকহারে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে অধস্তন কর্মকর্তারা ব্যবসা শুরু করছেন। পরে তথ্য গোপন করে তারা উভয়েই ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। অনেকে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। এ বিষয়টি সামনে আসে গত বছর দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়। এরপর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত বছর সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ড যেন জবাবদিহিতার আওতায় থাকে, এ জন্য আচরণ বিধিমালা আরও স্পষ্ট করা হচ্ছে। অনেক নির্দেশনায় পরিবর্তন আসছে। প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা যুগোপযোগী করে শিগগির চূড়ান্ত করা হবে।

বহুল প্রচলিত ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ বইয়ের লেখক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা একাধিকবার সংশোধন করার পরও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ঠিক করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসতে হবে।

আমলাদের বিরোধিতা: শুরু থেকেই আমলারা এটির বিরোধিতা করছেন। এ নিয়ে কয়েকজন আমলা সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দেন-দরবার, তদবিরও করেছেন। তারা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, এটি দিলে নেতিবাচক ধারণা হবে এবং এটি সরকারের বিরুদ্ধেই যাবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, আমলাদের প্রকাশ করা শঙ্কাগুলো প্রধানমন্ত্রী পাত্তা দেননি। এখন তারা সম্পদের হিসাব দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন অজুহাত দাঁড় করিয়েছে, জিয়াউর রহমানের আমলের আইন তাই রাখা যাবে না।

কেন বিরোধিতা: বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি দপ্তরের পিয়ন থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতির বিষয়টি সবারই জানা। অনেক অফিস সহকারী, গাড়িচালকের শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানত বৈধ আয়ের বাইরের আয় লুকিয়ে রাখার প্রবণতা থেকেই সম্পদের হিসাব দিতে অনীহা।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনের টাকার কর দিতে হতো না। ফলে তারা আয়কর রিটার্নও জমা দিতেন না। কিন্তু অনেকের বেতনের বাইরেও আয় আছে। এ কারণে সম্পদের হিসাব দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়নের জন্য কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। অনলাইনে জমা দেওয়ার বিধান চালু করতে হবে। তাহলে সহজেই জমা দেওয়া যাবে এবং পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হিসাব দিতে বাধ্যবাধকতার কোনো বিধান নেই। এ ছাড়া নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সম্পদের হিসাব দেওয়ার অঙ্গীকার করার পরও মানছেন না। এমপিদের সম্পদের হিসাব-সংক্রান্ত বিল সংসদে পাস হয়নি। এসব কারণে অস্বচ্ছতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা সম্পদের হিসাব চেয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন, আগে তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এতে অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা বার্তা যাবে। তাহলে এ উদ্যোগ সহজে বাস্তবায়ন হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিধানটি বাস্তবায়ন করা উচিত। শুধু সম্পদের হিসাব নিলেই চলবে না, হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া বেতার কিংবা টেলিভিশন অথবা কোনো সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে নিজ নামে অথবা বেনামে বা অন্যের নামে কোনো নিবন্ধন বা পত্র লিখতে পারেন না। খসড়া আচরণবিধিতে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কঠোরতা আরোপ করে পৃথক প্রজ্ঞাপনও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আমলারা একই আচরণবিধির নিয়মে সম্পদের হিসাব না দিলেও তথ্য প্রকাশে রাজি হন না। অন্তত ৩০ জন অতিরিক্ত সচিব বলেন, তারা আচরণবিধি অনুযায়ী গণমাধ্যমে কথা বলতে পারেন না।


পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)