মুজিব বর্ষ এবং আমাদের প্রত্যাশা

শিক্ষা প্রতিদিন ডেস্ক
শিক্ষা প্রতিদিন ডেস্ক,
প্রকাশিত: ০৪:১৩ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০১৯

মুজিব বর্ষ এবং আমাদের প্রত্যাশা
শিক্ষা প্রতিদিন ডেস্ক ||
আগামী ২০২০ সাল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০তম জন্মদিন। ইতোমধ্যেই উক্ত সালটিকে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা কর হয়েছে। মুজিবর্ষে বর্তমান সরকারের অর্জন দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হবে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি মাথায় রেখে সব সেক্টরই তৎপর হয়ে উঠেছে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য। শিক্ষাখাতও বসে নেই, পরিপত্রের পর পরিপত্র জারী হতেই আছে। ডিজিটাল শ্রেণি পাঠদানের জন্য উর্ধচাপ, নি¤œচাপ, পার্শ্বচাপ কোনটাই আর বাদ থাকছে না। কিন্তু পরিপত্র জারী করলেই কি সব হয়ে যাবে? সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লম্ফ-ঝম্প সেই এক পা ওয়ালা ঘাটিয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে কি হাঁটতে পারতো না কিন্তু ঘাটের মাশুলের জন্য বসে থেকে এমন তম্বি-হম্বি করতো যে ভয়ে কোন মানুষ ভাড়া না দিয়ে যেতো না। আমাদের দশাও হয়েছে তাই। আমার জানা মতে ২০০৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সীমিত পর্যায়ে কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে।

বর্তমানে খুব কম প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে সচল কিংবা অচল কম্পিউটার নেই। ল্যাব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৮ সালের জনবল কাঠামোতে ল্যাব সহকারী পদও সৃষ্টি করা হয়েছে যার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। ব্যাস, শিক্ষা ব্যবস্থা ডিজিটাল হয়ে গেল! দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়টি দেখা-শোনা করছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়। দেশের কল্যাণে তিনি নিবেদিতভাবে স্বীয় কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন।
ইতোমধ্যে দেশের অনেক সেক্টর ডিজিটালাইজড হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে সব ক্ষেত্রেই হবে শুধুমাত্র বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাদে! তবে বিএসবি ফাউন্ডেশন, শাহীন শিক্ষা পরিবারের মত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা ভিন্ন। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটালাইজড করার জন্য সরকার পর্যাপ্ত ব্যয় করছে, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো মোটা অংকের ভর্তি এবং টিউশন ফি গ্রহণ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে, আর বিভিন্ন বাহিনীর প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই চিত্র বিদ্যমান। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তি খাতে যা ব্যয় করা হয় তার একটি মোটা অংক ব্যয় করা হয় শিক্ষকের পিছনে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য শিক্ষক সমাজকে মোটা অংকের বেতনের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে প্রেষণা দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির কি হাল? শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকার অনুদান দিয়ে পরিচালনা করছে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এমপিও ও নন-এমপিও মিলে প্রায় ৪০ হাজার। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে ৭০-৮০ শতাংশ অবদান রাখছে। ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের দিকটি বিবেচনা করা উচিৎ নয় কি? শহরকেন্দ্রিক সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও বাকিগুলোর অবস্থা নাজুক। গ্রাম্য এলাকার জনগণ শিক্ষার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেও শিক্ষার পিছনে ব্যয় করা তাদের মানসিকতায় কুলোয়না। উপরন্তু এসব এলাকায় দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা অনেক।
তারা সন্তানের লেখা-পড়ার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারেন না, অনেকের সামর্থ্য থাকলেও অর্থ ব্যয় করার মানসিকতা নেই। ব্যক্তিগত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপবৃত্তিধারী, ১০-২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তিধারী, ২০-৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফুল কিংবা হাফ ফ্রি’র আওতায়। অবশিষ্ট থাকে ২০-৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ সামান্য পরিমাণ শিক্ষার্থীর টিউশন ফি দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে ওটুকুও থাকে না। নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি আদায়ের প্রশ্নই অবান্তর। প্রশ্ন উঠতে পারে উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের বিপরীতে সরকার ভূর্তকী দেয়। পাঠক, ভূর্তকীর কথা কি আর বলবো? সেই ৯০’র দশকে সম্ভববতঃ ১৯৯৪ সালে স্কুল পর্যায়ে যখন প্রথম উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু হয় তখন শিক্ষার্থী প্রতি ভূর্তকী দেয়া হয়েছিল ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা, ৯ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ২০ টাকা। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভূর্তকীর হার মাসিক ৫০ টাকা। কালের বিবর্তনে দুই যুগ পার হয়ে গেছে, কয়েক ধাপে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ অথচ ভূর্তকীর হার অপরিবর্তিত রয়েছে! প্রাতিষ্ঠানিক আয়ের খাতের মধ্যে বাকী থাকলো ভর্তি ফি, রেজিষ্ট্রেশন ফি, ফরম ফিলাপ, পরীক্ষার ফি। কয়েক বছর থেকে সরকার রেজিষ্ট্রেশন ফি এবং ফরম ফিলাপে বেশি না নেয়ার জন্য পরিপত্র জারী করে আসছে। ভর্তি ফি এর হার উপজেলা সদরের বাহিরে স্কুল পর্যায়ে ৫০০ টাকা, কলেজের ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা। গ্রাম্য এলাকায় উক্ত হারে ফি আদায় হয় না। পরীক্ষা বাবদ যে টাকা আয় হয় তা উক্ত খাতেই ব্যয় হয়ে যায়। উপরোক্ত হিসেব অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কত টাকা আয় করতে পারে? উল্লেখ্য যে, কিছু উপজেলায় মাধ্যমিক স্তরে উপবৃত্তির হার ১০০ ভাগ। এখন ব্যয়ের দিকে একটু নজর দেই। একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের খাতগুলো হচ্ছে- চক, ডাস্টার, কাগজ,
কলম, আপ্যায়ন, ভ্রমণ, বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ, বিদ্যুৎ বিল, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ক্রয়, মেরামত, আসবাব পত্র ক্রয়, বই ক্রয়, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, খন্ডকালীন শিক্ষকের বেতন, নন-এমপিও শিক্ষকের ভাতা প্রভৃতি। উপরোক্ত সামান্য আয় দিয়ে বছর চলতে চায় না। অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন থেকে চাঁদা দিতে হয়। ফলে দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল পাঠদানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের সকল শিক্ষার্থীকে সমসুযোগ দেয়া রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব নয় কি? আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি সহযোগিতা ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলিকে ডিজিটালাইজড করা আদৌ সম্ভব নয়। সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার দিয়েছে, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দিয়েছে কিন্তু শতভাগ প্রতিষ্ঠানে এ সুবিধা এখনো পৌঁছায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মকতার পরিদর্শন প্রতিবেদনে মাণ্টিমিডিয়া শ্রেণি কক্ষের সংখ্যা উল্লেখ করতে হচ্ছে। যে যার মত তথ্য দিচ্ছেন, না দিয়ে তো উপায় নেই। সরকারের নির্দেশ প্রতিদিন কমপক্ষে ৫টি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস নিতে হবে এবং প্রতিদিন তথ্য পাঠাতে হবে। ক্লাস হোক আর না হোক তথ্য পাঠানো হচ্ছে, উপর থেকে পাঠাতে বলা হচ্ছে। এছাড়া উপায় কি? সরকার কিছু প্রতিষ্ঠানে ১টি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়েছে যার বেশিরভাগই এখন চলে না, কম্পিউটার চলে না, নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে না একটি প্রজেক্টর নিয়ে বিভিন্ন ক্লাসে দৌড়াদৌড়ি করা কিংবা একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস নেয়া অত্যন্ত ঝামেলাপূর্ণ কাজ এবং সময়ের অপচয় উপরন্তু ক্লাস চলাকালীন বিদ্যুৎ চলে গেলে একুল-ওকুল দু’কুলই নষ্ট। উপরওয়ালার কথামত মল্টিমিডিয়া শ্রেণি কক্ষ
স্থাপন সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ১০-২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এটি সম্ভব কেননা একটি পূর্ণাঙ্গ মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরি করতে কক্ষ বাদে বর্তমানে কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা প্রয়োজন। উপরন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কক্ষের অবস্থা খারাপ যেখানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা সম্ভব নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানে পৃথক মাল্টিমিডিয়া ক্লাস তৈরি করার জন্য পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালাইজডকরণের আরোও একটি বড় বাধা শিক্ষক নিজেই।

স্কুল পর্যায়ে প্রতিদিন শিক্ষকদেরকে ৫-৬টি করে ক্লাস নিতে হয় উপরন্তু অধিকাংশ শিক্ষকই কম্পিউটারে অজ্ঞ। সরকারের চাপাচাপিতে ইতোমধ্যে যতটুকু বিজ্ঞ হয়েছেন তাতে কাংখিত ফল আশা করা যায় না। তাছাড়া কম্পিউটার শেখা এবং কন্টেন্ট তৈরি করে কিংবা ডাউনলোড করে শ্রেণি পাঠদান করার সময় কোথায়? প্রাতিষ্ঠানিক সময়ের বাইরে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ যে যার ক্ষেত্রে বাড়তি আয়ের চেষ্টা না করেন তাহলে পরিবারের অবস্থাও হবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের মত শিক্ষাক্ষেত্র বাদ দিয়ে ডিজিটালাইজেশনের চিন্তা করা আদৌ সম্ভব নয়। আর এজন্য প্রয়োজন সরকারি সার্বিক সহযোগিতা। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উপকরণ সরবরাহ, জনবল বৃদ্ধি, শিক্ষকের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধিকরণ ডিজিটালাইজেশনের অন্যতম পূর্ব শর্ত।

বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লবের অন্যতম কর্ণধার জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই- আপনার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ অবশ্যই
ডিজিটালাইজড হবে তবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান অন্তরায়গুলো দূর করতে হবে। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সরকার ডিজিটালাইজেশনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাখাতের ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার বেশিরভাগটাই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কাছে। যাদের অর্থে দেশ পরিচালিত
হচ্ছে তাদের সন্তানরাই সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাইলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের আওতায় আনতে হবে। এ পরম সত্যটি আপনার মা তথা মাননয়ী প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে একমাত্র আপনিই বোঝাতে পারেন। এতে আপনিও সফল হবেন, বাংলাদেশও
ডিজিটালাইজড হবে। মুজিব বর্ষ এদেশের হতভাগা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বয়ে নিয়ে আসবে আনন্দ বার্তা এ কামনা নিরন্তর।

আইউব আলী
অধ্যক্ষ
চিলাহাটি গার্লস্ স্কুল এন্ড কলেজ
ডোমার, নীলফামারী।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)