শিক্ষার্থীর মনে স্কুল ভীতি জন্মে যেসব কারনে

নিজস্ব প্রতিনিধি
নিজস্ব প্রতিনিধি,
প্রকাশিত: ০৬:০৭ পিএম, ৩ জুন ২০১৯ | আপডেট: ০৮:১৪ পিএম, ৩ জুন ২০১৯

অলোক আচার্য
আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় একটি শিশু সাধারণত চার বছর হওয়ার পরেই তাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় যা অল্প কয়েক বছর হলো প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি চালু হয়েছে। যখন হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেনে এসব শ্রেনি বিভিন্ন নামে চালু রয়েছে। বহু আগে থেকেই কিন্ডারগার্টেনে পড়ালেখা করা একজন শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রাথমিকের চেয়ে এগিয়ে থাকতো। মাঝে মধ্যে পত্রিকার পাতায় প্রাক প্রাথমিকের আগে একটি শ্রেণি চালু করার কথা শোনা গেলেও বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতি জানা যায় নি। শিশু পরিবারে বেড়ে ওঠার পর্যায়ে সাধারণত তিন বছর বয়স থেকেই শেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মা বাবার কাছ থেকে আমাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিচিতি এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে পরিচিত হয় এবং এসবের ভাষান্তর করতে শেখে। এসব জ্ঞান লাভের এক পর্যায়ে শিশুকে বিদ্যালয়ের সাথে পরিচিত হতে হয়ে।

একটি নতুন পরিবেশে নতুন মুখ এসবকিছু থেকে শিশু স্বাভাবিকভাবেই ভীত হয়ে পরে। তাকে মা বাবা এবং শিড়্গক উৎসাহ দিলেও তার মধ্যে একধরনের ভয় বা সংকোচ কাজ করতে থাকে। এই ভয় স্কুল ভীতি নামে পরিচিত। সাধারণ ভাষায় শিশুর এই ভীতির বিষয়টাকে স্কুল অ্যাভয়ডেন্স, স্কুল রিফিউজাল বা স্কুল ফোবিয়া বলা হয়। যে সকল শিশু স্কুল পলায়নের প্রবণতা বা এ নিয়ে অজুহাত দেখা যায় তারা স্কুল ফোবিয়ায় আক্রান্ত। আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে স্কুল ভীতি ব্যাপকভাবে কাজ করে। স্কুল মানেই ছাত্রছাত্রীর নিকট কেবল লেখাপড়া এবং শিক্ষকের শাস্তির জায়গা। যে কারণে স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও কাজ করে। যদি কোন ছাত্রছাত্রীর শ্রেণির কাজ প্রস্তুত না হয় তাহলে সে হয় স্কুলে যায় না অথবা স্কুলে গেলেও সেই ক্লাস ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। এই স্কুল ভীতি ছাত্রছাত্রীর অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত থেকে যায়। স্কুল ভীতি থেকে তার ভেতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিও অনীহা জন্ম নেয়। অনেকেই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে স্কুল কলেজের লেখাপড়া শেষ করে। তবে এই ভীতি বা ধারণা উচ্চ মাধ্যমিক বা তার পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে পরিবর্তিত হয়।

যদিও আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে শিক্ষকদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়। কিন’ বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কাগজে কলমে বিধিনিষেধ থাকলেও বাসত্মব অবস্থা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজও শারীরিক শাস্তি বহাল রয়েছে। মাঝে মাঝে পত্রিকার পাতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের আঘাতে আহত হওয়ার খবর আমরা পাই। প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। শিক্ষকরা আজও লেখাপড়া করার উপায় হিসেবে শারীরিক শাস্তিকেই উত্তম উপায় হিসেবে বোঝেন। শারীরিক শাস্তির ভয়ে যে ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে না এমন নয়। শাস্তি প্রদানও একটি উপায়। এই পদ্ধতিটি অস্থায়ী এবং একরকম বল প্রয়োগপূর্বক গেলানোর মতো অবস্থা। যা মনের ওপর চাপ বৃদ্ধি করে এবং যে পড়া প্রস্তুতের জন্য শাস্তি দেয়া হয় তা খুব বেশি সময়ের জন্য মনে থাকে না। কারণ যে পাঠের সাথে আনন্দ নেই সেই পাঠ মস্তিস্ক বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। কিন’ এই পদ্ধতিটি সেকেলে এবং আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে মোটেই সমর্থন করে না।

স্কুল ভীতি বা অনীহার একটি বড় কারণ হলো এই শস্তি প্রদান। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ছাত্রছাত্রীকে শাস্তির পরিবর্তে উৎসাহমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়। উৎসাহ প্রদান বা পড়ালেখায় মনোযোগী করতে ইতিবাচক পদ্ধতি গ্রহণের বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী কখনোই উৎসাহ হারায় না। এবং যে পাঠ আনন্দের সাথে গ্রহণ করা হয় তা অপেক্ষাকৃত স্থায়ী। শারীরিক শাস্তির পাশাপাশি মানসিক শাস্তিও কম প্রভাব ফেলে না। শারীরিক শাস্তি শরীরে প্রভাব ফেলে আর মানসিক শাসিত্ম অনেক সময় মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ড়্গত ড়্গেত্র বিশেষে শারীরিক শাসিত্মর চেয়েও মারাত্বক হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় শ্রেণি কক্ষে শিক্ষক পড়া না হওয়া বা বুঝতে না পারা অনুপস্থিতির কারণে তাকে বকাঝকা করা হয়। কোন কোশ ক্ষেত্রে সেই ছাত্রছাত্রীকে এমন সব ভাষায় তিরষ্কার করা হয় যা অনভিপ্রেত। এসব বিষয় শিড়্গার্থী বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, পড়া না হলে অনেক সময় শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নিয়ে কটু মন্তব্য করা হয়। শাস্তির বিধান থেকে শিড়্গকদের সরে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। কারণ এই ধারণা এখনো প্রবল যে শারীরিক শাস্তির দ্বারা শিক্ষার্থীর লেখাপড়া এবং তাকে শাসন করা সম্ভব। তাই আইন থাকা সত্ত্বেও তারা অনেকেই আইন মানছেন না বা আইন মেনে চলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার শতভাগ করতে হলে বিদ্যালয়কে একটি আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যেখানে পড়ালেখার কৌশল হবে
আনন্দময়।

পরীক্ষা বা মূল্যায়ন বিষয়টি এতদিন এই আনন্দময় কৌশলের একটি প্রতিবন্ধক ছিল। তবে সম্প্রতি তৃতীয় শ্রেণি পর্যনত্ম পরীড়্গা না নেয়ার সিদ্ধান্ত ছাত্রছাত্রীকে পাঠে আনন্দময় করে তুলবে বলে মনে হয়। এই বিষয়টি ছাড়া বিদ্যালয়ে শাস্তি প্রদান বিদ্যালয় বিমুখতার অন্যতম কারণ। একটি আনন্দময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মূল ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকরা। যেহেতু দিনের একটি বড় সময় তারা স্কুল কলেজে পার করে ফলে তাদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতে হবে। না হলে স্কুল ফোবিয়া কোনদিনই কাটবে না। কখনোই স্কুল কলেজ কোন আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠবে না। পূর্ণ বয়সে স্কুল কলেজের স্মৃতি যতই মধুর হোক না কেন যে সময়ে তার স্কুল ভালো লাগার কথা সে সময়ে অনাগ্রহ থেকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায় আবদ্ধ করে গেলানোর চেষ্টা করা হয়ে আমাদের কাঙ্খিত লক্ষে পৌছাতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে।

অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
পাবনা
মোবাইলঃ ০১৭৩৭ ০৪৪৯৪৬
Email- sopnil.roy@gmail.com


পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)