তিস্তা নিয়ে ‘মন্তব্য’ নেই নরেন্দ্র মোদির

আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান,
প্রকাশিত: ০৭:০৯ এএম, ২৮ মার্চ ২০২১

ছবিঃ সংগৃহীত
ঢাকাঃ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ব্যস্ত কর্মসূচিতে কাটিয়ে বহুল আলোচিত দু’দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি দিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান। সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার মোদির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসূচি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক। দ্বিপক্ষীয় ওই শীর্ষ বৈঠকে ৫টি সমঝোতা সই হয়েছে। উদ্বোধন হয় ৯টি প্রকল্প।

বাংলাদেশ সফর এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে মোদি এক টুইট বার্তায় বলেন, আমার সফরকালে বাংলাদেশের জনগণ যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে তার জন্য আমি তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও তাঁর উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমার বিশ্বাস, এই সফর আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সকল বিষয়ে বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছি এবং ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ আরও গভীর করার উপায়গুলো নিয়েও আলোচনা করেছি।

বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন- তিস্তা সমস্যার সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ নিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের মন্তব্য করেননি নরেন্দ্র মোদি।

মন্ত্রী জানান, সীমান্তে আর একজন বাংলাদেশিও যেনো বিএসএফ কর্তৃক নিহত না হয়, তা নিশ্চিতের জোরালো দাবি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সীমান্তে শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার লক্ষ্যে কম্প্রিহেনসিভ বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের আওতায় বিজিবি ও বিএসএফকে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাবার নির্দেশনা দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ঝুঁকিপূর্ণ চলাফেরা পরিহার করতে সীমান্তবর্তী এলাকার নাগরিকদেরকে সচেতন করে তোলার কার্যক্রম পরিচালনারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মন্ত্রী জানান, যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ওপর বাংলাদেশের অলংঘনীয় অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতোই জোরালোভাবে উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তিস্তার পানি বণ্টনের “অন্তর্বর্তী চুক্তি” দ্রুত সম্পাদনের জোর দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন ।

মন্ত্রী বলেন, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার-এই ছয়টি যৌথ নদীর পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্তকরণের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা সেচ প্রকল্পে কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রহিমপুর খালের অবশিষ্টাংশ খননের আবশ্যকতার ওপর গুরুত্বারোপ করে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্বাক্ষরে ভারতের দ্রুত সম্মতি কামনা করেছে বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক হাজার স্কলারশিপের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। মানবসম্পদ ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, সন্ত্রাসবাদের অবসান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রগতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জিত অভূতপূর্ব সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব যৌথভাবে উদ্যাপনের বিভিন্ন পরিকল্পনাও তাদের আলোচনায় স্থান পায়। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ২০২২ সালে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করেছিল ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। দিনটিকে “মৈত্রী দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর-নদীয়া সড়কটিকে “স্বাধীনতা সড়ক” নামকরণে বাংলাদেশের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যস্ততা ও সময়-স্বল্পতার কারণে এখনই সড়কটি উদ্বোধন করা না গেলেও, ভারতীয় পক্ষের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের পর যৌথ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে অচিরেই এটি উদ্বোধন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আনা এবং বাণিজ্য অবারিত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন মেজার নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষ ট্যারিফ এবং নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার অপসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য রপ্তানির ওপর ২০১৭ সাল থেকে ভারত কর্তৃক আরোপিত এন্টি ডাম্পিং ডিউটিগুলো প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার ওপরও দুই প্রধানমন্ত্রী জোর দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ভারতীয় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিস্তৃত আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন দুই নেতা। সড়ক, রেল ও নৌপথে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী উদ্যোগসমূহের প্রশংসা করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। “ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ট্রাইলেটারাল হাইওয়ে প্রকল্পে যুক্ত হতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা ভারতকে জানানো হয়েছে। বিবিআইএন এগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে এমওইউ দ্রুত স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তার ওপর দুই নেতা বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আরো বৃহত্তর পরিসরে একসেস চেয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য বাংলাদেশ নতুন কিছু রুট অনুমোদনের জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্ব, সময় ও ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা, বিশেষতঃ নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। নেপাল ও ভুটানে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ ব্যবহারে আগ্রহী বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে সদ্য সম্পাদিত যৌথ বিবৃতি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এনার্জি ডেফিসিট এলাকায় বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে চাই। লাইন অব ক্রেডেটির আওতাধীন প্রকল্পগুলোকে আরো বেগবান করার ব্যাপারেও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ভারত। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে “বঙ্গবন্ধু চেয়ার” স্থাপনের ঘোষণাও দিয়েছে ভারত।

মন্ত্রী বলেন, চিরায়ত সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক নৈকট্য এবং ঐতিহাসিক মেলবন্ধনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত বহুমুখী অংশীদারিত্ব বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বিবর্তিত, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বানানো একটি করে সোনা ও রুপার কয়েন মোদিকে উপহার দেন শেখ হাসিনা। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে সাজানো একটি রুপার কয়েন দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে বাংলাদেশকে ভারত সরকারের দেয়া করোনা প্রতিরোধক ১২ লাখ ডোজ টিকা উপহারের প্রতীক বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে তুলে দেন মোদি। এছাড়া শেখ হাসিনার হাতে ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্সের প্রতীকী চাবি দিয়েছেন তিনি।

সফরের দ্বিতীয় দিনে মোদি ঢাকার বাইরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া সফর করেছেন। বিশ্বের কোনো সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের এটাই ছিল প্রথম টুঙ্গিপাড়া দর্শন। বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা মোদিকে তাদের পৈতৃক ভিটায় স্বাগত জানান। সেখানে জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মোদি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি যান। সেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে তিনি মতবিনিমিয় সভায় মিলিত হন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৩ কোটি মতুয়া সম্প্রদায়ের বাস। সমালোচনা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে মতুয়া মন জয় করতেই নাকি মোদি তাদের তীর্থস্থান পরিদর্শনে গেছেন। তবে সেখানে দেয়া বক্তৃতায় মোদি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলেননি বরং তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের জীবন-মান উন্নয়ন বিশেষতঃ ওড়াকান্দিতে মেয়েদের শিক্ষা এবং শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভারত সরকারের সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার সফর বিষয়ে এদিন বাংলা ভাষাতেই একের পর এক টুইট করেছেন। তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত মতুয়া দর্শন বিষয়ক টুইটে বলা হয়- ‘ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি দর্শনের অভিজ্ঞতা আমি আজীবন মনে রাখব। এই অত্যন্ত পবিত্র স্থানটি মহান মতুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সংসদে আমার সহকর্মী শ্রী শান্তনু ঠাকুর শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরজীর মহান বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রশংসনীয়ভাবে প্রয়াস করছেন। ওড়াকান্দিতে শান্তনুজী এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান পরিদর্শন বিষয়ে তিনি তার টুইট বার্তায় লিখেন- ‘টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। আজ সকালে টুঙ্গিপাড়ায় বিশেষভাবে উপস্থিত থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাজী এবং শেখ রেহানাজীকে ধন্যবাদ জানাই। তার আগে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালী মন্দির পরিদর্শন করেন মোদি। সেখানে পূজা দেন। এ বিষয় টুইটে মোদি লিখেন- ‘আমি সমগ্র পৃথিবীর মঙ্গল কামনা করে মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেছি। সর্বত্র শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করুক।’


পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)